নারীদের ক্যান্সার প্রতিরোধের জন্য একটি আগাম পন্থাঃ কারণ, সনাক্তকরণ এবং জীবনধারা
‘ক্যান্সার’ শব্দটি আমাদের মধ্যে ভীতি তৈরি করে। সবার কাছে সমস্ত রোগের মধ্যে ক্যান্সারকে সবচেয়ে ভয়ংকর মনে হয়। বাংলাদেশে বার্ষিক ক্যান্সার শনাক্তের সংখ্যা প্রায় দেড় লাখ। বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ১২০০০০ মানুষ ক্যান্সারের কারণে মৃত্যুবরণ করে ।আগামী বছরগুলিতে এই সংখ্যা আরো বাড়বে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) মতে, ২০৩০ সালের মধ্যে আক্রান্তের হার দ্বিগুণ হবে। বাংলাদেশে ক্যান্সারের সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। একটা সময় ছিল যখন আমরা শুনতাম ‘ক্যান্সার’ এমন কিছু যা বন্ধুর বন্ধুর মধ্যে ধরা পড়েছিল। এটাকে মারাত্মক কিন্তু আমাদের জানা মানুষ থেকে দূরে বলে মনে হতো। কিন্তু, আজকাল, আমরা কেবল আমাদের আশেপাশের মানুষের মধ্যেই নয়, বরং আমাদের নিজের পরিবারেও ক্যান্সার আক্রান্তের কথা শুনি।
মহিলাদের মধ্যে আমরা সাধারণতো যে ক্যান্সারের কথা শুনি সেগুলি হলো স্তন ক্যান্সার, সার্ভিকাল ক্যান্সার, এবং ওরাল ক্যাভিটি ক্যান্সার।
কারণসমূহ
ক্যান্সার আক্রান্ত হওয়ার পিছনে একটি নির্দিষ্ট কারণ চিহ্নিত করা কঠিন। এটি বেশ কয়েকটি কারণের মিশ্রণ হতে পারে যা আপনার শারীরিক স্বাস্থ্যের সাথে দীর্ঘদিন ধরে সংযোগে আছে।
তামাক বা ধূমপানঃ আমরা যখন তামাক সম্পর্কে শুনি, তখন আমরা ধরে নিই এটি শুধুমাত্র ধূমপানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। কিন্তু এটি আমাদের দেশে স্বাভাবিক অনেক ভোজ্য সামগ্রীতে, যেমন গুল, খৈনি, এবং জর্দার মধ্যে বিদ্যমান।
স্থুলতাঃ অতিরিক্ত ওজন আপনার ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি বৃদ্ধি করে। মহিলাদের ক্ষেত্রে ঝুঁকি আরও বেড়ে যায়, বিশেষ করে ডিম্বাশয়ের ক্যান্সার, স্তন ক্যান্সার, অগ্ন্যাশয়ের ক্যান্সার, এবং পিত্তথলির ক্যান্সারের জন্য।
মদ্যপানঃ যদিও এটি বাংলাদেশে একটি সাধারণ অভ্যাস নয়, তবুও, এটি আমাদের ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি বাড়ায়।
আমাদের দেশের দূষিত পরিবেশ এবং ভেজাল খাবার আমাদের ক্যান্সারের সম্ভাবনা বৃদ্ধি করে ।
মহিলাদের মধ্যে ক্যান্সারের কারণ
উপরে উল্লিখিত ক্যান্সারের কারণগুলি মহিলাদের জন্য বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। এছাড়া কিছু সাধারণ কারণ রয়েছে যা তাদের ক্যান্সার সম্ভাবনা আরও বাড়িয়ে দেয়:
- হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস সংক্রমণ (এইচপিভি সংক্রমণ)
- বাল্যবিবাহ
- ঘন ঘন গর্ভধারণ করা
- দেরীতে বিয়ে (৩০ এর শেষের দিকে)
- জেরিয়াট্রিক বা দেরীতে গর্ভধারণ করা (৩৫ বছরের পরে গর্ভাবস্থা)
প্রাথমিক লক্ষণ
আপনার শরীরে ক্যান্সার শুরু হওয়ার আগে, প্রাথমিক পর্যায়ে বেশ কয়েকটি লক্ষণ প্রকাশ পেতে পারে।
- ঘন ঘন কাশি
- দীর্ঘায়িত কাশি
- কাশির সাথে রক্ত
- খাবার গিলতে অসুবিধা
- হজমের সমস্যা
- অন্ত্রের সমস্যা
- শরীরে সিস্ট বা পিণ্ড অনুভব করা; বিশেষ করে স্তন ক্যান্সারের জন্য সত্য
- তিলে এবং আচিলের স্পষ্ট পরিবর্তন
- অস্বাভাবিক জায়গা থেকে রক্তপাত
ক্যান্সার সনাক্তকরণ
আপনি জিজ্ঞাসা করতে পারেন, "আমি যদি এই লক্ষণগুলি দেখাই তবে এর মানে কি আমার ক্যান্সার আছে?" অথবা "ক্যান্সার প্রতিরোধে আমি কী করতে পারি, বিশেষ করে একজন নারী হিসেবে?" মহিলাদের ক্যান্সারের হার প্রতিরোধে কে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে? উত্তর হল নারী নিজেই। বাংলাদেশে বেশিরভাগ নারীদের ক্যান্সার প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে অর্থাৎ এটির চিকিৎসা করা সম্ভব বা আরও বিস্তার রোধ করা সম্ভব। বিশেষ করে, স্তন ক্যান্সার, জরায়ুর ক্যান্সার, এবং ওরাল ক্যাভিটি ক্যান্সার প্রাথমিক পর্যায়ে চিকিৎসা করা যেতে পারে। সময়মত সনাক্তকরণের মাধ্যমে সম্ভাব্য ক্যান্সারের লক্ষণগুলি সনাক্ত করতে এবং মোকাবেলা করার জন্য কয়েকটি সক্রিয় পদক্ষেপ আপনি নিতে পারেন।
স্তন ক্যান্সার
একজন মহিলার সবচেয়ে বড় উদ্বেগের একটি হল স্তন ক্যান্সার সনাক্ত হওয়া। প্রাথমিকভাবে সনাক্ত করা হলে, স্তন ক্যান্সার নিরাময়ের হার অত্যন্ত বেশি।
২০ বছর বা অধিক মহিলাদের জন্য, "স্ব স্তন পরীক্ষা" নামে একটি সহজ পদ্ধতি রয়েছে যা তারা বিনা খরচে ঘরে করতে পারেন। এই পরীক্ষা করার সময় আপনি যদি আপনার স্তন বা বগলের অংশে কোনো পিণ্ড বা সিস্ট লক্ষ্য করেন এবং এর সাথে ক্যান্সারের কোনো লক্ষণ দেখান, তাহলে অবিলম্বে একজন ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করুন।
এই জিনিসগুলি কখনই বিলম্বিত করবেন না। এক বা দুই মাসের বিলম্ব আপনার রোগের অবস্থা বদলে দিতে পারে।
প্রতি মাসে একবার নিজের স্তন পরীক্ষা করা উচিত। আপনি নিজেই এটি সম্পাদন করতে পারেন। পরীক্ষাটি করার আদর্শ সময় হলো আপনার মাসিক শেষ হওয়ার ৭-১০ দিন পর ।
৩৫ বছর বা অধিক মহিলাদের জন্য, বছরে অন্তত একবার একজন ডাক্তার দ্বারা ক্লিনিকাল স্তন পরীক্ষা করার পরামর্শ দেওয়া হয়।
৪০ বছর বা অধিক মহিলাদের জন্য, প্রতি ১-৩ বছরে একটি ম্যামোগ্রাম করা ভাল। কিন্তু, আপনার ডাক্তারের পরামর্শের পরে ম্যামোগ্রাম করা উত্তম।
জরায়ু ক্যান্সার এবং সার্ভিক্স ক্যান্সার
৩০ বছর বা তার বেশি বয়সী মহিলারা জরায়ু ক্যান্সার প্রতিরোধের জন্য বাংলাদেশ সরকারের কর্মসূচির অধীনে VIA পরীক্ষা পেতে পারেন। আপনি প্রতি তিন বছরে একটি পরীক্ষা করাতে পারেন।
ডাক্তার যদি আপনার VIA পরীক্ষায় কোনো অসঙ্গতি খুঁজে পান, তাহলে তারা একটি কোলনোস্কোপি টেস্ট বা পরবর্তী প্রয়োজনীয় পদক্ষেপের পরামর্শ দিবেন।
৯ থেকে ১৩ বছর বয়সী প্রতিটি মেয়ের জন্য জরায়ু ক্যান্সারের টিকা অপরিহার্য। আপনি যদি এই বয়স অতিক্রম করে থাকেন তবে চিন্তা করবেন না। আপনি একজন ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করার পরে এটি দিতে পারবেন।
বাংলাদেশে স্তন ক্যান্সার এবং জরায়ুর ক্যান্সার পরীক্ষা
বাংলাদেশ সরকার নারীদের ক্যান্সার প্রতিরোধে একটি প্রকল্প করেছে। এই প্রকল্পের অধীনে, স্তন এবং জরায়ুমুখের ক্যান্সার স্ক্রীনিং প্রোগ্রাম বাংলাদেশ সরকার সম্পূর্ণ বিনামূল্যে প্রদান করে।
আপনি উপজেলা হাসপাতাল, জেলা সদর হাসপাতাল, মেডিকেল কলেজ এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের সন্ধান করতে পারেন।
প্রাথমিক সনাক্তকরণের গুরুত্ব
ক্যান্সারকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়।
এক তৃতীয়াংশ প্রতিরোধযোগ্য ক্যান্সার। যদি একজন ব্যক্তি কয়েকটি নির্দিষ্ট পদক্ষেপ অনুসরণ করেন, তাহলে তারা এই ধরনের ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমাতে পারেন। এর মধ্যে জরায়ুর ক্যান্সার, ফুসফুসের ক্যান্সার এবং ওরাল ক্যাভিটি ক্যান্সার উল্লেখযোগ্য।
এই ক্যান্সারের বিকাশের জন্য দায়ী কারণগুলি থেকে সচেতনভাবে দূরে থাকার মাধ্যমে, আপনি ঝুঁকি অনেক কমাতে পারেন।
দ্বিতীয় ক্যাটাগরিতে রয়েছে সেসকল ক্যান্সার যা প্রাথমিক পর্যায়ে ধরা পড়লে উপযুক্ত চিকিৎসার মাধ্যমে সম্পূর্ণ নিরাময় করা যায়। এর মধ্যে আছে স্তন ক্যান্সার, জরায়ু মুখের ক্যান্সার, মুখের ক্যান্সার, ফুসফুসের ক্যান্সার সহ আরও অনেক প্রকার।
প্রাথমিক পর্যায়ে এসব ক্যান্সারের লক্ষণগুলো লক্ষ্য করে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে পারেন। প্রথম পর্যায়ে ধরা পড়লে সঠিক চিকিৎসা নেয়া যেতে পারে। সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকে।
তৃতীয় এবং শেষ ভাগ হল ক্যান্সার যা নিরাময় বা প্রতিরোধ করা যায় না। সেসকল ক্ষেত্রে, উপশমকারী যত্নের মাধ্যমে, আমরা ক্যান্সার রোগীদের জন্য একটি মানসম্পন্ন জীবন নিশ্চিত করার চেষ্টা করতে পারি।
লেখকঃ
ডাঃ মোহাম্মদ মাসুমুল হক
এম বি বি এস, এম পি এইচ
প্রতিষ্ঠাতা, ক্যান্সার এওয়ারনেস ফাউন্ডেশন অফ বাংলাদেশ
Download Chondo App
Track your period and get notified.
Download
Beta