|

বডি ডিসমরফিক ডিসঅর্ডার: এই কঠিন অবস্থা বোঝার এবং চিকিৎসা করার জন্য একটি নির্দেশিকা

বাংলা

বাংলাদেশের সামাজিক প্রেক্ষাপট থেকে যদি বলি, একটি কন্যা সন্তানের জন্মের পর তার গায়ের রং,চুল থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত নানাবিধ তথাকথিত সৌন্দর্যের মানদণ্ডের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে বিচার করা হয়। চারপাশ থেকে এমন পরিবেশ পেয়ে, দেখে বা শুনে আমাদের নিজেদের মধ্যেও এমন মন্তব্য করার প্রবণতা তৈরি হয়। ফলশ্রুতিতে, আমরা অনেক সময় আমাদের কাছের মানুষ কিংবা বন্ধুদের মজার ছলে বলি- তুমি মোটা হয়ে গেছো, কালো হয়ে গেছো ইত্যাদি। কিন্তু আমরা কি কখনো ভেবে দেখেছি আমাদের এই শুনতে বা দেখতে সাধারণ মন্তব্যগুলো যাকে উদ্দেশ্য করে করেছি তা তাদের মানসিকভাবে দুর্বল করে দিতে পারে, হীনমন্যতা তৈরী করতে পারে? কখনো কখনো তা জটিল আকার ধারণ করে এবং তাদের মানসিকভাবে অসুস্থ করে দেয়। সুতরাং আপাতত দৃষ্টিতে, এসব মন্তব্য খুবই নিরীহ প্রকৃতির মনে হলেও এই মন্তব্যগুলো ভয়ংকর রুপ আকার ধারণ করতে পারে।

অনেকের মনের মধ্যেই নিজের দৈহিক গঠন নিয়ে অস্বাভাবিক ভ্রান্ত ধারণা তৈরি হয়। নিজের শরীরের গঠন বা বাহ্যিক চেহারা সম্পর্কে মনের মধ্যে অহেতুক চিন্তা এবং এমন সব বদ্ধমূল ধারণার জন্ম দেয় যে, তা শেষ পর্যন্ত মারাত্মক সমস্যার আকার নেয়। এমনকি এই ধরণের সমস্যায় আক্রান্তরা স্কুল, কলেজ বা কাজের জায়গায় যাতায়াত বন্ধ করে দেয়। মনোবিজ্ঞানের ভাষায়, একে বলা হয় Body Dysmorphic Disorder. এটিতে ছেলে মেয়ে উভয়েই আক্রান্ত হতে পারে। তবে মেয়েদের ক্ষেত্রে পিরিয়ডের কারণে, সামাজিক, পারিবারিক আচরণ, মন্তব্য এবং বৈবাহিক সূত্রে আবদ্ধ হওয়া সঙ্গীর সাথে টক্সিক সম্পর্ক সহ নানাবিধ যৌন নির্যাতনের কারণে এর উপস্থিতি তুলনামূলক বেশি। পিরিয়ড অন্যতম একটা কারণ। যেহেতু এই সময় নানা রকম শারীরিক পরিবর্তন এবং মানসিক পরিবর্তন আসে। ফলে পিরিয়ডের সময় অন্যান্য ফ্যাক্টর গুলোর সাথে হরমোনের পরিবর্তন এর রিস্ক ফ্যাক্টর বাড়িয়ে দিতে পারে।

Body Dysmorphic Disorder কি?

ত্রুটিপূর্ণ দেহ কাঠামোজনিত বিকার বা বডি ডিসমরফিক ডিসঅর্ডার (বিডিডি) এমন এক ধরনের মানসিক ব্যাধি, যেখানে একজন মানুষের মনে তার ত্রুটিযুক্ত শারীরিক কাঠামো বা চেহারার গড়ন নিয়ে নানা অলীক চিন্তাভাবনার উদয় হয়। সাধারণভাবে এই ধরনের সমস্যায় আক্রান্ত ব্যক্তির মনে তার নাক, গায়ের রং, কান বা ঠোঁটের গড়ন প্রভৃতি নিয়ে খুঁতখুঁতে মনোভাব থাকে। এই কারণে তারা আয়নায় বারবার নিজেদের দেখে বা পরিবারের সদস্য, বন্ধুদের কাছে নিজেদের ত্রুটিযুক্ত চেহারার গড়ন সম্পর্কে নানা প্রশ্ন করে। নিজেদের শরীরের গঠনগত অস্বাভাবিকতা সম্বন্ধে তারা মনে নানা ধরনের বদ্ধমূল ধারণার জন্ম দেয় এবং সমস্ত সামাজিক যোগাযোগ থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে নেওয়ার প্রবণতা দেখা দেয়। কারও কারও মধ্যে মানসিক চাপ এতটাই বেড়ে যায় যে, সার্জারির মাধ্যমে তারা তাদের চেহারার কাঠামোগত ত্রুটি দূর করতে উঠে-পড়ে লাগে। যদিও এমন পদ্ধতি অবলম্বন করা সত্ত্বেও তাদের মনের এই ভুল ধারণার কোনো পরিবর্তন হয় না।

যেসব মানুষের মধ্যে ত্রুটি প্রকৃত রূপে থাকে না এবং যাদের ত্রুটি থাকলেও তা আপাতভাবে চোখে ধরা পড়ে না, তাদের উভয়ের মধ্যেই দেহের কোনো না কোনো অংশের গঠনগত ত্রুটি প্রায়শই অসন্তোষের জন্ম দেয়।বডি ডিসমরফিক ডিসঅর্ডার ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের মধ্যে বেশী পরিলক্ষিত হয়। গবেষকরা BDD কে একটি বৃহৎ মানসিক সমস্যা অর্থাৎ অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিসঅর্ডারের অন্তর্ভুক্ত বলে মনে করেন এবং OCD এর অনেকগুলো Spectrum-এর মধ্যেBDD অন্যতম। OCD-র ক্ষেত্রে যেমন বংশগত বা জৈবিক উপাদানের সমাহার লক্ষ্য করা যায়, তেমন বিডিডি-র ক্ষেত্রেও এমন উপাদানের উপস্থিতি দেখা যায়।

ইতিহাসঃ

ইতালীয় মনোবিদ এনরিকো মোর্সেলি ১৮৯১ সালে সর্বপ্রথম বিডিডির ওপর আলোকপাত করেন। তিনি একে ডিসমর্ফোফোবিয়া নামে অভিহিত করেন। এটি গ্রিক শব্দ 'ডিসমরফিয়া' থেকে এসেছে যার অর্থ কুৎসিত। শব্দটির প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় হেরোটোডাসের ইতিহাস গ্রন্থে।

এরপর আরেক ফরাসি মনোবিদ পিয়েরে জ্যানেত এই ব্যাধিকে 'l’obsession de la honte du corps' বা 'Obsessions of shame of the body' নামে অাখ্যায়িত করেন এবং একে অবসেসিভ কম্পালসিভ নিউরোসিসের অন্তর্ভুক্ত করেন। ১৯৮০ সালে রোগটি 'Atypical somatoform disorder' নামে অ্যামেরিকান সাইকিয়াট্রিক অ্যাসোসিয়েশনের তৈরি করা মানসিক রোগের শ্রেণীবিন্যাস এর ৩য় সংস্করণে (DSM-II) স্থান পায়। ১৯৮৭ সাল থেকে এটি Body Dysmorphic Disorder নামে পরিচিত হতে থাকে। বিশ্বখ্যাত পপ গায়ক মাইকেল জ্যাকসন বডি ডিসমরফিক ডিসঅর্ডার রোগে আক্রান্ত ছিলেন। চিকিৎসকদের নিষেধ সত্ত্বেও জীবদ্দশায় তিনি মোট ১১ বার কসমেটিক সার্জারি করিয়েছিলেন। এছাড়াও ফ্রাঞ্জ কাফকা এবং সিলভিয়া প্লাথের মতো লেখকও এই রোগে আক্রান্ত ছিলেন বলে জানা যায়।

উপসর্গঃ

  • অসংলগ্ন চিন্তাভাবনা পরিলক্ষিত হয়।
  • সর্বক্ষণ নিজেকে নিয়ে হীনমন্যতায় ভুগতে থাকে।
  • দৈহিক গঠন/কাঠামো নিয়ে অহেতুক চিন্তা ভাবনা করা।
  • রাগ, হতাশা সৃষ্টি হয়।
  • শারীরিক বা দৈহিক ত্রুটির কথা ভেবে নিজেকে আলাদা করে ফেলা,সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশ না নেয়ার প্রবণতা দেখা যায়।
  • ঘন ঘন আয়নায় নিজেকে দেখার প্রবণতা তৈরি হয়।
  • শরীরের যে অংশ নিয়ে হীনমন্যতায় ভুগে তা সার্জারী করে ঠিক করতে চাওয়ার প্রবণতা দেখা দেয় এবং সার্জারী করার পরেও তাদের এই হীনমন্যতা দূর হয় না।বরং বারবার সার্জারী করতে চাওয়ার একটা লক্ষণ দেখা দেয়।
  • ক্রমাগত নিজেকে অন্যের সাথে তুলনা করা।
  • অনেকের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা তৈরি হয়।

কারণমূহঃ

BDD এর সুনির্দিষ্ট কারণ এখনো জানা যায় নি। নারী এবং পুরুষ সমানভাবে এই ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়। কিছু কারণ আছে যা বডি ডিসমরফিক ডিসঅর্ডার ট্রিগার হওয়ার ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয় বলে মনে করা হয় –

  • পরিবারের কারো শুচিবায়ু জনিত মানসিক সমস্যা থাকলে।
  • মাত্রাতিরিক্ত পারফেকশনিজমের ফলে সৃষ্টি হয় অসহনীয় মানসিক উদ্বেগ,যা থেকে BDD তে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
  • পারিবার ,সমাজ ও বন্ধুমহলে শারীরিক গঠন / চেহারার গড়ন নিয়ে হাসাহাসি বা ব্যঙ্গবিদ্রুপের শিকার হওয়া।
  • বুলিং এর শিকার হওয়া।

এছাড়াও থ্যালামাস ফিল্টারিং অব থটস এর কাজ করে। গবেষণায় দেখা গেছে যাদের এই প্রক্রিয়া ঠিকঠাক কাজ করে না তাদের মধ্যে নিজের শারীরিক গঠনগত ত্রুটি নিয়ে যে থট তা কম্পালসিভ ভাবে আসতে থাকে এবং ব্রেইনের Structural Defect or Structural Deformity এর কারণেও BDD হতে পারে।

চিকিৎসাঃ

বডি ডিসমরফিক ডিসঅর্ডার ক্ষেত্রে Combined Treatment প্রয়োজন হয়। BDD এর Treatment তিনটি ধাপে করা হয়- ফিজিক্যাল, মেন্টাল, সোশ্যাল।

ফিজিক্যাল ট্রিটমেন্টঃ ব্যক্তিকে এই ক্ষেত্রে অবজার্ভ করে , পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ওষুধ দেয়া হয় যেমন Antidepressant drugs.

মেন্টাল ট্রিটমেন্টঃ BDD এ আক্রান্ত ব্যক্তির মেন্টাল ট্রিটমেন্ট বা কাউন্সেলিং একটি দীর্ঘ মেয়াদী প্রক্রিয়া। উইকলি ১টা করে প্রায় ১২ টা সেশন দরকার হয়।

সোশ্যাল ট্রিটমেন্টঃ BDD আক্রান্ত ব্যক্তির আশেপাশে থাকা যেমন পরিবারের সদস্যদেরও কাউন্সেলিং প্রয়োজন হয়। পরিবারের সদস্যদের এটা বোঝাতে হবে যে এটা একেবারেই এড়িয়ে যাওয়ার মতো মানসিক সমস্যা নয়। সার্জারি করতে চাওয়ার ব্যাপার টাকে প্রশ্রয় দেয়া যাবে না। এই বিষয় সম্পর্কে পরিবারের সদস্যদের সচেতন করা প্রয়োজন। সর্বোপরি রোগির আশেপাশে থাকা মানুষদের এই রোগ সম্পর্কে সচেতন করা এবং রোগির সাথে তাদের আচরণ কেমন হওয়া উচিত তা বুঝানো হয়।

চিকিৎসায় সব রোগীর আউটকাম একরকম হয় না। মানুষ হিসেবে আমাদের অন্যের প্রতি সহমর্মি হওয়া উচিত। লক্ষ্য রাখা উচিত আমাদের কোনো কথা বা মন্তব্য যেন অন্যকে ছোট অনুভুত না করায়।

বরং ইতিবাচক কথা , প্রশংসাসূচক বাক্য বা শব্দ আমাদের অপর প্রান্তে থাকা মানুষটিকে শক্তি দিতে পারে , জীবন বদলে দিতে পারে।

Download Chondo App

Track your period and get notified.

Download

Beta

Similar Posts

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।